কিছু লোক আছে,
যাদের অভাব কোনোদিন শেষ হয়না। সবসময়ই শুধু হাত পেতে রাখে।
কিন্ত এদের কাছে কোনোদিন সাহায্য সহযোগিতা আশা করা যায়না।
কিছু লোক আছে,
যে কারো সমস্যায় এরা নাক গলাবেই।
যদিও এদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই সমাজে।
কিছু লোক আছে,
যারা নিজেদের অত্যধিক জ্ঞানী মনে করে। কোনো বিষয়ে ভালো ধারনা না থাকা স্বত্ত্বেও এরা আগ বাড়িয়ে পরামর্শ দিতে আসে। যারা নেতিবাচকতা ছড়ায়। তারা তাদের কথা ও মন্তব্যের বিষ দিয়ে মানুষকে অসাড় ও কর্মহীন করে দেয়।
কিছু লোক আছে,
যারা জাত হিংসুটে স্বভাবের হয়। কারো উন্নতিতে এরা শুধু জ্বলে।
এরা স্বভাবতই অন্যের সমালোচনা করে। যেকোনো ভালো কাজের খুঁত বের করে সমালোচনার একটা উৎস বের করে। একটা ভালো কাজকে মুহুর্তেই এরা ত্রুটিযুক্ত করে তোলে।
কিছু লোক আছে,
ইচ্ছে করেই বিপদ ডেকে আনে। সহানুভুতিশীল মানুষদের সহমর্মিতায় এরা পৈশাচিক আনন্দ নেয়। নিজের ক্ষতিটা এদের কাছে গৌণ।
এদের কারনেই সত্যিকারের বিপদগ্রস্থরা সাহায্য হতে বঞ্চিত হয়।
কিছু লোক আছে,
ভরা মজলিসে কোনো গুরুত্বপুর্ণ মিটিংয়ে মোবাইলে ফোন এলে এরা উচ্চস্বরে কথা বলে। বাসে, ট্রেনে, ভার্সিটির ক্লাস কিংবা হাসপাতালে, সর্বত্রই এরা বিনাসংকোচে ফোনে জোরে কথা বলে।
এমনকি মসজিদে নামাজ পড়তে গেলেও এরা মোবাইল সাইলেন্ট করেনা। এদের সামাজিক পরিচয় 'কান্ডজ্ঞানহীন' মানুষ। শুধু কি এরাই কান্ডজ্ঞানহীন?
তাহলে বাকিদের আখ্যা কী !
কিছু লোক এমন আছে,
আপনি রুম থেকে বেরিয়ে দেখবেন আপনার জুতার উপর তিনি তাঁর নোংরা জুতাজোড়া রেখে দিয়েছেন। বিশেষ করে মসজিদ মন্দির কিংবা কোনো অফিস থেকে বের হওয়ার সময় এই বিরক্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।
অন্যের জুতার উপর নিজের জুতাজোড়া রাখা লোকদের বিবেকবোধ কেমন হতে পারে?
এই ঘটনাগুলো বেশিরভাগ মেস/হোস্টেলে হয়ে থাকে।
উপরোক্ত সব 'কিছু লোক' এর মোট সমষ্টিতে এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
এরা এদের কর্মকান্ডের জন্য কোনোদিন লজ্জিতও হয়না।
সেজন্য সমাজে সৎ লোক খুঁজতে হয়।
আবার কিছু লোক এমনও আছে, যাদের মধ্যে উল্লেখিত সব শ্রেনির গুনাগুণ রয়েছে।
আপনি আমি, আমরা। উপরোক্ত গুণগুলো আমাদের মধ্যে নেই, এই নিশ্চয়তা দিতে পারলে তবেই আমরা ভালো মানুষ.
আমি তাকে আগেও দেখেছি
দেখেছি সূর্যের আলোর প্রখর উজ্জলতায়
তার চোখের দ্বীপ্তিতে উজ্জল ছিল আমার পথ
হ্যাঁ,উনি আমার শিক্ষক ছিলেন।
আজ শেষ বিকেলের ম্লান আলোয় উনাকে আবার পেলাম পথে
দীর্ঘরোগভোগের শরীর নিয়ে তিনি এলেন সামনে
চোখের প্রখর উজ্জলতা অস্তাচলে
কথা হলো,গল্প হলো
তবে একজন শিক্ষক ও একজন ছাত্রের কথোপকথন নয়
একজন রোগাক্রান্ত বৃদ্ধের সাথে আমার কথা হলো
কথা হলো যাপিত জীবন নিয়ে
কথা হলো সন্তান নিয়ে
কথা হলো- সাফল্যের সংগা নিয়ে।
আর দুজন একমত হলাম এই বিষয়ে আমরা চক্রাকারে
জীবনের প্রতিটি সময়কে পাবো এ পৃথিবীতে-
যৌবনের তেজী অহংকারী সময়কে
মধ্যযৌবনের শান্ত-সৌম্য সময়কে
আর বৃদ্ধ বয়সের শ্রদ্ধা আর ধূসরঅবহেলার সময়কে।
আমি তাকে আগেও পেয়েছি
আমি তাকে আজও পেলাম
বহুদিন পরে- আমার শিক্ষককে।
আমার কালি কলমের “এই সময়” শুরু হয়েছিল ২০১২ সালে। কি মনে করে KAIDULI নামক ব্র্যান্ডের একটা কলম কিনলাম যাতে Piston টাইপের ইংক কনভার্টার আছে কিনা তা নিশ্চিত হয়েই। কারন রাবারের Bladder যুক্ত Squeeze টাইপ ইংক কনভার্টার আমার কাছে একেবারেই সেকেলে মনে হত। তারপর কিনলাম BAOER 516 ঐ বছরই একই জায়গা সেই নিউমার্কেট থেকে। লিখে যা আরাম...। সেকেলে ইংক কনভার্টার থাকা সত্ত্বেও এরপর কিনলাম এক নাম না জানা (কলমের গায়ে কোন Brand Name খোদাই করা নেই) গাঢ়হ্ নীল রং এর ছোট একটা কলম। আসলে একেবারে অপ্রচলিত ছোট আকৃতির জন্যই তা কেনা। বেশ smoothly লেখা যেত এই কলমে। তবে কিছুদিন পর ওটার ইংক কনভার্টার Bladder দিয়ে কালি leak করা শুরু করল। সে কারনে ওটা আর ব্যবহার না করলেও রেখে দিয়েছি। কারন ঐ কলমটা ছিল অনেক অনেক সুন্দর। সবশেষ যে কলমটা কিনলাম তা ছিল একেবারেই Traditional. মানে “সেই সময়কার” কলম “এই সময়কার” নয়। সেই সময় যত বিভিন্ন রকম ব্র্যান্ডের যেমন Hero, Youth অথবা Wing Sung ব্যবহার করতাম না কেন, আমার ব্যবহার করা ঐ সব কলমের আকৃতি-প্রকৃতি ছিল মোটামুটি একই রকম। সব আধুনিক আকৃতির কলমের মিছিলে একটা সেকেলে আকৃতির থাকুক, সে চিন্তা থেকেই কলমটা কেনা। তুলনামূলক কম দামে আর কোন কালি না পাওয়ায় পাকিস্তানী Dollar নামক ব্র্যান্ডের কালি ব্যবহার করতাম। রং ছিলো কালো, নীল, লাল ও সবুজ। লাল রংটা ব্যবহার না করলেও আমার সবচেয়ে পছন্দের সবুজ কালিটা করেছি। আমার ডায়রীর পাতা আর গাছের সবুজ পাতার মধ্যে বিস্তর কোন তফাৎ ছিলো না, কেননা লেখালেখিতে ঠাসা ডায়রীটা ছিল সবুজে ভরপুর। সব কলম গুলো ভালোই ব্যবহার করেছিলাম। দৈনন্দিন যে কোন লেখালেখি অর্থাৎ বাজারে ফর্দ থেকে শুরু করে লেকচার নোট নেয়া, এমনকি পরীক্ষা দেয়া পর্যন্ত সবই হত কালি কলমের ব্যবহার করে। এক কথায় “সর্বস্তরে কালি/ঝর্না কলমের সর্বোচ্চ প্রচলন/প্রয়োগ” করেই ছাড়লাম কোন প্রকার ছাড় না দিয়েই। তারপর.... তারপর আর কি, দিন শেষে আমি বাঙ্গালী। আর সেই বাঙ্গালী হুজুগে হবে না, তা তো হতেই পারে না। খুব স্বাভাবিকভাবেই এবং নিশ্চিতভাবেই কালি কলমের হুজুগ এক সময় বেলা শেষের সূর্যালোকের মতই মিইয়ে আসে। আসে নিকষ কালো আধাঁরের নিস্তব্ধতা। গুনে গুনে পাচঁটি বছর... এই পাচঁটি বছর কলমগুল পড়ে রইল কোন এক ড্রয়ারে কোণে। মনেই রইল না যে কালি কলম বলে কোন বস্তু আমার আছে।
এরপর আসিল ২০১৭ সাল। বছরের মাঝামাঝি Youtube এ ঘটনাচক্রে দেখিলাম Brian Goulet১ এর কালি কলম বিষয়ক একখানা video। অতঃপর হুজুগে বাঙ্গালীর হুজুগের দ্বিতীয় পর্ব আরম্ত হইল (নাকি কোন এক খলনায়কের লাঠির সজোড় বাড়ি মস্তকে পড়িয়া অতীত স্মৃতি ফিড়িয়া আসিল)। পুনরায় বলি ইহা ২০১৭ সাল, ২০১২ সাল নহে। কম্পিউটার নামক যন্ত্রের বোতাম চাপিলেই কলমের দাম পরিশোধ হইয়া যায়। তাহাতে কলমে পাখা গজায়। তাহা উড়িয়া উড়িয়া সুদূর যুক্তরাষ্ট্র হইতে আমার অধিকারে আসে। আহা কি সৌভাগ্য আমার। কলমের পশ্চাতে আর দৌড়-ঝাঁপ করিতে হয় না। উপরন্তু কলমই আমার নিকটে আসিয়া পড়ে। একে একে আসিল Jinhao x750, x250, 992 আর সর্বশেষে Croco Rome Dile.
এইমাত্র যে কালি কলমগুলোর কথা বললাম এগুলো সবই Chinese ব্র্যান্ড। তারপরও আমার কাছে বেশ ভালই লাগছে লিখতে।Jinhao x750 টার প্রায় পুরো অংশই Stainless Steel এর তৈরি। ভারি। ধরলে মনে হয় কিছু একটা জিনিষ হাতে নিয়ে রেখেছি। কলমের নিবটা পরিবর্তনযোগ্য। কলমটার ক্যাপে brand name আর model name যেভাবে খোদাই করে লেখা তা আমার ভাল লেগেছে এবং Overall কলমের ডিজাইন বাড়াবাড়ি গোছের মনে হয়নি। কলমের ক্যাপটা পেছনে ঠিকঠাক মত লাগলেও শতভাগ যুতশইভাবে লাগে না। হাত যাদের বড় বলে কলমের ক্যাপটা কলমের পেছনে লাগিয়ে ব্যবহার করবেন তাদের জন্য বিষয়টা বিরক্তিকর মনে হতে পারে।
মামা!মামা!
খোকা কিছু বলছে?
ছিমছাম পাতলা গড়নের এক লোক। হাতে দামী মোবাইল। পায় সু। পরনে লুঙ্গি। চেক একটা শার্ট গায়ে। ডান হাতের দু'আঙ্গুলের মাঝে বেন্সন সিগারেট। মাঝে মাঝে টান দেন। তাড়াহুড়ো তাড়াহুড়ো ভাব। দোকানের সামনে দাড়িয়ে দোকানে বসা খোকার বড় ভাই রাহাদকে প্রশ্ন করে জানতে চাইলো লোকটা।
তাকায় খোকার বড় ভাই মাদরাসার ছাত্র রাহাদ। সে খোকার মুদি দোকানের পার্ট টাইম হেলপার। পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ভাইর দোকানে সময় দেন। ছোট ভাইকে সাহায্য করাই মূল উদ্দেশ্য।
খোকার ভাই রাহাদ উত্তর দেয় না মামা খোকা কিছু বলেনি তো।
ওহ সীট! কিছুই বলেনি?
না, কেন মামা? রাহাদ জানতে চায়।
পরে বলবো মামা। লোকেটার প্রতি উত্তর।
সে বলতো বলতে খোকাকে খোঁজতে চলে গেলো।
মনে হলো তার হাতে কোন সময় নেই। চেহারায় টেনশনের ছাপ। চিন্তিত।
কিছুক্ষন পর হুহু করে আবার দোকানের সামনে। মামা খোকা কে তো পাইলাম না। কই গেছে আপনি বলতে পারেন?
না মামা রাহাদ উত্তর দেয়। আমি জানি না। হয়ত আশেপাশেই আছে। কই আর যাইবো।
কেন মামা আমাকে বলা যায়? রাহাত বলে।
হিম মামা! আপনার সাথেই কাজ।
আমার সাথে? রাহাদ উত্তর দেয়।
আপনার সাথে আমার কাজ! রাহাদ বিস্মিত হয়। একই সাথে ভয়ও পায়। কারন লোকটা মাস্তান। তার পেশাই হলো মাস্তানি করা।
কিন্তু খোকার সাথে ভাল সম্পার্ক। নিয়মিত খরিদদার। সব সময় নগদ টাকা দিয়ে কিনে খায়। বাকী খায় না। অবশ্য রাহাদ সব সময় খোকাকে সাবদান করতো। তাদের সাথে জামেলায় না জরাতে। এখন মনে হচ্ছে নিজেই জরিয়ে যাচ্ছে।
পৃথিবীর মধ্যে রাজনীতিবিদ আর মাস্তানকে বিশ্বাস করতে নাই। এই ধারনা রয়েছে রাহাদের। অবশ্য পুলিশও তিনি বিশ্বাস করেন না। তাই এই তিন প্রকার লোকদের সাথে সতর্কতার সাথে চলেন। কারন কোন সময় বিপদে পরে যান কে জানে! আল্লাহ রহম করো। মনে মনে বলে
আজ কি এই মাস্তানের সাথে কোন বিপদে পরতে যাচ্ছে না তো। মনে মনে ভাবে রাহাদ।
আল্লাহর উপর ভরশা করে রাহাদ।
সাহস নিয়ে জানতে চায়।
মামা কোন সমস্যা?
লোকটা উত্তর দেয় না মামা। ছোট সমস্যা আপনি সমাধান করতে পারবেন। খোকাকে বলতে বলছিলাম। কিন্তু ও কেন বলল না?
জানি না?
সময়ও নেই?
কি যে করি?
গড় গড় করে বলে চলল লোকটা।
কোন সমস্যা নাই আপনি আমাকে বলতে পারেন?
আ...প....না.....কে বলবো।
আমতা আমতা করে বলল লোকটা।
ওকে আপনাকে বলি।
আপনি একটু সন্ধ্যায় রেডি থাকবেন?
ওকে? লোকটা রাহাদকে বলে।
ছেদ করে ওঠে রাহাদের মনের মধ্যে।
রাডি থাকবো মানে!
না না ওরকম কিছু না।
এই টুপিটা পরবেন আর পান্জাবিটা। লঙ্গি থাকলে সমস্যা নাই।
মানে!!!! রাহাদ বলে।
লোকটা বলে না! কোথায়ও যেতে হবে না।
আমরাই আসবো আপনার বাসায়।
কেন কি হয়েছে?
রাহাদ বলল।
আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
না,মানে! মামা! আপনার একটা বিয়া পরাতে হবে আর কি। হাহাহা।
বিয়ে? চুপ রাহাদ।
হাসতে হাতে বলে লোকটা
আপনার রুমেই চলে আসবো মেয়েকে নিয়া। বলতে বলতে চলে গেলো। আর দেরি করলো না।
রাহাদ বলল....... বি..........য়া............!!!"! (চলবে
মিথ্যে বলা কি পাপ???
শিয়ালের আঙ্গুরফল টকের গল্প আমরা সবাই জানি। আঙ্গুর পাড়তে না পারার ব্যর্থতা স্বীকার করার পরিবর্তে শিয়াল আঙ্গুরের দোষ ধরে বা মিথ্যে কথা বলে। আবার "ভাঁড়ার ঘরে কেরে? আমি কলা খাইনা" - তেও চুরি করে নিজের কলা খাওয়ার অপরাধ অস্বীকার করতে বা নিজের দোষ অন্য কারো ঘাড়ে চাপানোর জন্য মিথ্যে বলা হয় ।
সাধারণভাবে আমরা জানি, মানুষ বিপদে পড়লে মিথ্যে কথা বলে। তবে সবসময় শুধু বিপদে পড়লেই মানুষ মিথ্যে কথা বলে - এমনটা কিন্তু নয়। আঙ্গুর পাড়তে পারেনি, একথা স্বীকার করলে শিয়ালের এমন কোন বিপদ হবেনা। কারণ পৃথিবীর কোন শিয়ালই গাছে উঠে আঙ্গুর পাড়তে পারেনা। বা "আমি কলা খাচ্ছি" - বললে কেউ আপনাকে শাস্তি দেবেনা। এরকম অনেক পরিস্থিতিতে আমরা মিথ্যে বলি বা সত্য বিকৃত করি।
সব ধর্মেই মিথ্যে বলা মহাপাপ। কারণ মিথ্যে বলে মানুষ অনেক সময় অপরাধ গোপন করে, অন্যের ক্ষতি করে এবং ব্যাক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নানা অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য কোন কিছুকে স্বীকৃতি দেয় যা কাঙ্খিত নয়। তবে ধর্ম একথাও বলেছে যে, খুব বেশী বিপদে পড়লে মিথ্যে বলা যেতে পারে, তবে পারতপক্ষে না বলাই ভাল। আসুন জানি, মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মানুষের মিথ্যে বলার কারণ কি, মিথ্যে বলা খারাপ কিনা বা মিথ্যে বলার প্রয়োজনীয়তা কি?
প্রথমে জানি, মানুষ কেন মিথ্যে বলে?
সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য মানুষকে নানা প্রতিকূল পরিবেশের (সমস্যা, অসুবিধা, জটিলতা ইত্যাদির) সাথে খাপ খাইয়ে চলতে হয়। যেকোন
সমস্যামূলক পরিস্থিতিতে পড়লে মানুষের মনের উপর চাপ বা পীড়নের (Stress) সৃষ্টি হয়। এই চাপকে মোকাবেলা করতে না পারলে মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেনা, মানসিক ভারসাম্য হারায়, নানা মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। জীবনের নানা চাপমূলক পরিস্থিতিতে মানুষ সাধারণতঃ দুইভাবে প্রতিক্রিয়া করে থাকে। যথা -
১। কৃত্যমুখী প্রতিক্রিয়া ও
২। প্রতিরক্ষামুখী প্রতিক্রিয়া।
কৃত্যমুখী প্রতিক্রিয়া হল সমস্যামূলক পরিস্থিতিতে কাজ করে চাপ দূর করার বাস্তবমুখী প্রচেষ্টা। কৃত্যমুখী প্রতিক্রিয়া করতে পারলে মিথ্যে বলার দরকার পড়েনা। ব্যাক্তি এ প্রতিক্রিয়া তিনভাবে করে থাকে। যথা - সরাসরি মোকাবেলা ( সমস্যা চিহ্নিত ও পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে নিজ দক্ষতা, ক্ষমতা ও শক্তি প্রয়োগ করে সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ গ্রহণ), পশ্চাদপসরণ করা ( সমাধান অসাধ্য মনে করলে সমস্যা বা পরিস্থিতি থেকে সরে আসা) ও সমঝোতা করা (সমস্যার আংশিক সমাধান করে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়া বা চাপ কমানো )।
একটি উদাহরণ দিয়ে এই তিন পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করা যায়। ধরা যাক, একজন স্ত্রী তার স্বামীর আয় থেকে তার শ্বশুরবাড়ীতে টাকা দেয়া পছন্দ করেন না। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ হয়। এ পরিস্থিতিতে কলহ মেটাতে সরাসরি মোকাবেলায় স্বামী স্ত্রীর সাথে আলোচনা করে স্ত্রীকে পরিস্থিতি বুঝিয়ে টাকা দিতে রাজী করাতে পারেন। পশ্চাদপসরণে স্বামী স্ত্রীর কথামত টাকা দেয়া বন্ধ করতে পারেন বা স্ত্রীকে না জানিয়ে টাকা দিতে পারেন। সমঝোতাতে স্বামী বাবামার শুধু খুব জরুরী প্রয়োজনে, যেমন - শুধু চিকিৎসা খরচের টাকা দিতে স্ত্রীকে রাজী করাতে পারেন। বাকীটা তার অজান্তে করতে পারেন।
আমার এক ডাক্তার বন্ধু প্রেম করে বিয়ে করেছে। কিন্তু তার স্ত্রী তার বাড়ীর লোকেদের সাথে কথা বলেনা, ভাল আচরণ করেনা। তার কারণ আমার বন্ধুর পরিবার তার স্ত্রীর সাথে বিয়েকে মেনে নিতে চায়নি বলে। এ কারণে আমার ডাক্তার বন্ধু তার ছোট বোনকে তার বাসায় রেখে পড়াতে চেয়ে পারেনি। কারণ আমার ডাক্তার বন্ধুর বউ তার বোনের সাথে খারাপ ব্যবহার করে। তাই আমার বন্ধু আলাদা বাসা ভাড়া নিয়ে বাবামাকে এনে বোনসহ রেখে বোনকে পড়াচ্ছে। ছুটির দিনে বন্ধু তার ছেলেদের নিয়ে বাবামার কাছে যায়, বাজার করে বা টাকা দিয়ে আসে। বউ কখনোই যায়না। সে যেতে বলেওনা। ফলে বোনকে নিয়ে কোন অশান্তিও নেই। এখানে আমার বন্ধু দ্বিতীয় উপায় বা পশ্চাদপসরণ করে সমস্যা সমাধান করেছে।
আর প্রতিরক্ষামুখী প্রতিক্রিয়া (ডিফেন্স মেকানিজম) হল, যখন মানুষ কোন সমস্যার সমাধান করতে পারেনা বা সমস্যা বা সত্যের মোকাবেলা করা বা সত্য স্বীকার করা ব্যাক্তির জন্য অসুবিধাজনক, অসম্মানজনক ও বিব্রতকর হয়, তখন ব্যাক্তি মিথ্যে বলে ( সত্য বিকৃত করে, আংশিক সত্য বলে, সত্য ও মিথ্যা মিলিয়ে কিছু বলে)। এভাবে নানা আত্মরক্ষামূলক কৌশল অবলম্বন করে চাপ মোকাবেলা বা অভিযোজন করাকে প্রতিরক্ষামুখী প্রতিক্রিয়া বা ডিফেন্স মেকানিজম বলে। যেমন - কেউ নকল করে ধরা পড়লে সবার কাছে অপমানিত হওয়া থেকে বাঁচার জন্য বলে - "আমি নকল করিনি, পাশের জন করেছে। স্যার আমাকে ধরেছে।" বিমানবন্দরে চোরাকারবারীরা ধরা পড়ার পর বলে, "ঐ লাগেজ আমার না। একজন আমাকে পৌঁছে দিতে অনুরোধ করেছে।"
আমরা কিভাবে মিথ্যে কথা বলি?
প্রতিরক্ষামুখী প্রতিক্রিয়া করতে গিয়ে কখনও কখনও আমরা বিভিন্ন প্রতিরক্ষা কৌশল / ডিফেন্স মেকানিজম ব্যবহার করি বা মিথ্যে বলে মানসিক চাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করি। নীচে কয়েকটি ডিফেন্স মেকানিজমের উদাহরণ দেয়া হলো।
১। যুক্তিসিদ্ধকরণ : এর অর্থ নিজের অক্ষমতা বা দোষ ঢাকার জন্য মিথ্যে যুক্তি বা কারণ তুলে ধরা। শিয়ালের আংগুর ফল টক যুক্তিসিদ্ধকরণের উদাহরণ। তেমনি একজন ঘুষখোর নিজের ঘুষ খাবার অপরাধবোধ ঢাকে একথা বলে যে, "সবাই ঘুষ খায়। তাই ঘুষ খাওয়া অপরাধ নয় ( যদিও সে জানে তা অপরাধ এবং সবাই ঘুষ খায়না)"। ছোটভাইকে মেরে বড়ভায়ের অনুশোচনা হলে বড়ভাই নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেয় যে, "মারাই ঠিক হয়েছে। সে দুষ্টামী করেছে (যদিও সে জানে, তেমন কোন অন্যায় সে করেনি যারজন্য মারতে হবে)।" স্ত্রীর সাথে রাগারাগি করে মন খারাপ হলে স্বামী নিজেকে মিথ্যে বলে, " আমাকে রাগিয়ে না দিলে আমি এমন করতাম না (যদিও সে জানে স্ত্রী রাগিয়ে দেবার মত কিছু বলেনি)। স্বামী বা স্ত্রী নিজের পরকীয়ার অপরাধ জায়েজ করার জন্য মিথ্যে বলে, "আমার স্বামী বা স্ত্রীও পরকীয়া করে বা আমার প্রতি যথাযথ কর্তব্য করেনা"।
২। পশ্চাদগমণ: বর্তমান সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়ে মানুষ বার বার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়। যেমন - শ্বশুরবাড়ীতে মন বসেনা বলে ঘন ঘন বাপের বাড়ী গিয়ে কোন বউ শ্বশুরবাড়ীর মিথ্যে বদনাম করতে পারে। অফিসের পরিবেশে খাপ খাওয়াতে না পেরে শরীর খারাপের মিথ্যে বাহানায় ঘন ঘন ছুটি নিতে পারে। সংসার জীবনের নানা দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ কেউ মিথ্যে বলতে পারে, "ছাত্র অবস্থায়ই বা বিয়ের আগেই বেশী ভাল ছিলাম।"
৩। প্রক্ষেপণ: প্রক্ষেপণ বলতে বোঝায় নিজের আবেগ, ক্ষমতা, প্রবণতা বাইরের কিছুর উপর বা অন্য কারো উপর প্রতিবিম্বিত করা। যেমন - ফেল করা ছাত্র নিজের অক্ষমতা ঢাকার জন্য মিথ্যে বলতে পারে, "শিক্ষক ইচ্ছে করে ফেল করিয়েছে( নিজের দোষ শিক্ষকের উপর চাপানো)"। কোন ঘুষখোর নিজের ঘুষ খাওয়ার অপরাধের জন্য অনুশোচনা ঢাকার জন্য মিথ্যে বলতে পারে "অন্য লোকেরা আমার চেয়ে অনেক অনেক বেশী ঘুষ খায়। যদিও সে খুব ভাল করেই জানে যে, তার কথা ঠিক নয়। অনেক লোক কোন ঘুষই খায়না। একারণে দূর্নীতিবাজ লোক দূর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে সবচেয়ে বেশী।
৪। প্রত্যাহার : এটি হল হতাশা বা বিফলতা এড়ানোর জন্য ঝু্ঁকিপূর্ণ বা ভীতিকর পরিস্থিতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। যেমন - পরাজিত হবার ভয়ে বা লজ্জা এড়ানোর জন্য কোন ছাত্র দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ না নিয়ে মিথ্যে বলতে পারে, "অংশ নিলে অবশ্যই বিজয়ী হতাম (যদিও সে জানে সে তা হতনা)। আমিও সবসময় বলি, চেষ্টা করলে বড় লেখক, গবেষক, ভিসি বা নিদেনপক্ষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতাম নির্ঘাত।
৫। ফ্যান্টাসী: এটি হল বাস্তবে যা ঘটেনি বা ঘটা সম্ভব নয়, এমন কিছু কল্পনায় ঘটানো। যেমন - পড়া না পারার কারণে স্যারের বকা খেয়ে লজ্জিত কোন ছাত্র কল্পনায় প্রথম হয়ে স্যারকে চমকে দেয়। মার খেয়ে অপমানিত কেউ কল্পনায় যে মেরেছে তাকে মেরে তার নাক-মুখ ফাটিয়ে দিয়ে নিজেকে সন্তুষ্ট করে, যদিও সে জানে যে সেটা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
মিথ্যে বলার প্রয়োজনীয়তা কি?
প্রতিরক্ষামুখী প্রতিক্রিয়া মূলত আত্মপ্রতারণা, আত্মপ্রবোধ যা ব্যাক্তি সচেতন বা অবচেতনে করে মনের উপর নানা চাপ কমায়, পরিবেশের সাথে অভিযোজন করে। বাস্তবের কোন দিককে বিকৃত করে নিজেকে ধোকা দিয়ে নিজের ব্যর্থতা, অক্ষমতা ঢেকে নিজের আত্মসম্মানবোধ বা ইগোকে অক্ষুন্ন রাখে, নিজে সান্ত্বনা বা প্রবোধ লাভ করে। ফলে ব্যাক্তির মানসিক স্বাস্থ্য অক্ষুন্ন থাকে, জীবন অব্যাহত থাকে, মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়না। তাই কখনও কখনও মিথ্যে বলা জরুরী। পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো ৫ টি শর্তের উপর নির্ভর করে।
১। পরিবেশগত চাহিদাগুলোর মান ও সংখ্যা
২। ব্যাক্তির আভ্যন্তরীন চাহিদাগুলোর মান ও সংখ্যা
৩। পরিবেশগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা
৪। খাপ খাওয়ানোর জন্য ব্যাক্তির দক্ষতা
৫। কার্যকরী অন্য উপাদানসমূহ।
এই শর্তগুলো ব্যাক্তির পক্ষে যত অনুকূল হয়, তত তার উপযোজন, সমস্যা সমাধান সহজ হয়, নানা ডিফেন্স মেকানিজম ব্যবহার করা বা মিথ্য বলার প্রয়োজনীয়তা কম হয়।
মিথ্যে বলার অপকারীতাঃ
সবার মানসিক শক্তি, ক্ষমতা, খাপ খাওয়ানোর যোগ্যতা সমান নয়। তাই অনেকে প্রতিরক্ষা কৌশল প্রয়োগ করে নিজেকে সান্তনা দেয়, সত্যকে অস্বীকার করে, সত্য গোপন করে বা সত্য বিকৃত করে। মিথ্যে খারাপ হলে বিপদের সময়ও ধর্ম মানুষকে মিথ্যে বলার অনুমতি দিতনা। আমি কাউকে মিথ্যে বলতে উৎসাহিত করছি না। শুধু এটুকু বলছি, নিজেকে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখার জন্য নিজের আত্মশ্রদ্ধা অক্ষত থাকা জরুরী, কখনো কখনো তা সত্যকে বিকৃত করে হলেও। আমরা প্রতিনিয়ত তা করি নানা ডিফেন্স মেকানিজম ব্যাবহার করে। তবে এই ডিফেন্স মেকানিজম কেউ খুব বেশী ব্যবহার করলে তা তীব্র মানসিক বৈকল্যের লক্ষণ বলে ধরা হয়। তাই সমস্যামূলক পরিস্থিতিতে কৃত্যমুখী প্রতিক্রিয়া করা বেশী ভাল।
বাবামা, শিক্ষক বেশী কঠোর হলে শিশুরা মিথ্যে বলে মারা বা বকা বা অন্য শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য। পরিবারের বড়রা খুব বেশী আক্রমণাত্বক, প্রতিশোধপরায়ন ও অপমানকারী হলে শিশুরা মিথ্যে বলে। তাই বাবামার উচিত বাচ্চাদের প্রতি খুব কঠোর না হওয়া। ছোটবেলা থেকে মিথ্যে বলে অভ্যস্ত হলে বড় হলেও মিথ্যে বলবে। বাবামা অসৎ হলে বা তাদেরকে মিথ্যে বলতে দেখলে শিশুরাও বলবে। তাই বাবামার মিথ্যে, অন্যায় পরিহার করা উচিত।
মূলকথা: বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকে কৃত্যমুখী প্রতিক্রিয়া করতে শেখালে তারা ডিফেন্স মেকানিজম বা মিথ্যে বলে আত্মরক্ষা করতে শিখবে না। বাচ্চার দূর্বলতা শোধরানো, দোষ স্বীকার করার ও অন্যায়ের শাস্তি মাথা পেতে নেবার মানসিকতা তৈরী করে দিতে হবে। নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানো, অন্যায়কে ফালতু যুক্তি দিয়ে জায়েজ করতে, সমস্যা থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতে শিখবেনা। সর্বোপরি তারা নীতি-নৈতিকতা শিখবে।
খুব খুব ভাল থাকবেন বন্ধুরা।
পুনশ্চ: আমাব বিয়ের পর আমার ছোটভাই আমার আম্মাকে বলেছিল, "ওর ঘরে কাউকে থাকতে দিওনা। দু'দিন পর পর বরের সাথে ঝগড়া করে চলে আসবে। তখন থাকবে কোথায়?" আমি কিন্তু ঝগড়াটে নই। এটা মিথ্যে বলিনি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশুদের অনেক ভালো বাসতেন। তাঁর কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনাও শিশুদের অনেক ভালোবাসেন। সেই আর্দশে অনুপ্রানিত হয়ে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে ছাত্রলীগের সদস্যরা সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের মুখে ঈদের হাঁসি ফোটানোর জন্য তাদের মাঝে ঈদ উপহার প্রদান করেন। ঈদের আনন্দ থেকে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাও যেন বাদ না পরে তাই রাজধানীর ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় তারা নতুন পোষাক বিরতণ করেন। এছাড়া রাজধানীর পরীবাগে সুবিধাবঞ্চিতদের স্কুল ‘হাসিমুখ’-এর শিক্ষার্থীদের মাঝে ঈদের পোশাকসহ খাবার সামগ্রী বিতরণ করেন। এসব উপহারের মধ্যে ছিল ঈদের নতুন জামা, সেমাই, চিনি, পোলাওয়ের চাল, লবন, দুধ ইত্যাদি। ছাত্রলীগ সভাপতি নিজেই দীর্ঘ দিন যাবত এই স্কুলটি পরিচালনা করে আসছেন। প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে স্কুলটিতে। পরীবাগের হাঁসিমুখ স্কুলের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে ঈদের পোশাক বিতরণের মাধ্যমে তারা ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। এই সময় পথ শিশুরা ছাত্রলীগের সদস্যদের কাছে পেয়ে এবং তাদের কাছ থেকে ঈদ উপহার পেয়ে আনন্দে মেতে উঠে। ঈদের আনন্দ থেকে এসব সুবিধাবঞ্চিত শিশু যেনো বঞ্চিত না হয়, সেজন্য ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় তাদের ঈদ উপহার ছাড়াও অন্যান্য সময়েও শিক্ষা উপকরণ দেয়া হয়। এসব শিশু যেনো সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে পারে, সেজন্য ছাত্রলীগ এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের সব এলাকায় সুবিধাবঞ্চিত ও অবহেলিত শিশু, বৃদ্ধরা যেনো ভালোভাবে ঈদ উদযাপন করতে পারে, সেজন্য ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের খেয়াল রাখার আহ্বান জানান তারা। এর আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি)-তে ছিন্নমূল ও দুঃস্থ শিশুদের মাঝে ইফতার ও ঈদের নতুন পোশাক বিতরণ করেছিল ছাত্রলীগের কর্মীরা। দেশের সকল সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের কথা চিন্তা করে দলমত নির্বিশেষে দেশের সকল বিত্তবান ব্যক্তিরা এগিয়ে আসবে এমনটাই প্রত্যাশা আমাদের সকলের।
: উস্তাদ, ঈদতো শেষ, এহন কামে নাইমা পড়ি ?
: নামবি ? আচ্ছা নাম । তয় যা করার আপসে করবি, ঠেকঠুক দিস না, কাওর ঈদের খুশি মাটি করিস না ।
: না, না ঠেকঠুক দিমু না, খালি পায়ে ধইরা ছালাম কইরা ছালামি চামু ।
: যদি ছালামি না দেয় ?
: আবার ছালাম করুম।
: যদি আবার ছালামি না দেয় ?
: আবারও পায়ে ছালাম করুম ।
: এরপরেও যদি না দেয় ?
: হের জুতা দুইডা লইয়া দৌড় দিমু ।
: সাবাস ! যা নাইমা পর ।
৮ বছরে ১৭ টি একটানা ঈদ দেশের বাইরে করলাম।দেশের ঈদের আমেজ শুধু স্বপ্নেই দেখি।ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার রান্না করার সময় হয়েছে।সেমাই পায়েস কিছু একটা তো করতেই হয়,তাই না?
ঈদের আগের দিনের ঘোষণা,হই হুল্লোড়,ম্যাসেজ দেয়া নেয়ার তোড়জোড়,ঈদের সকালে চারদিকের মসজিদ থেকে ভেসে আসা
"আল্লাহু আকবার,আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লালাহু,আল্লাহু আকবার,আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ" আর "ঈদ মোবারকের" মুহর্মুহ ধ্বনির স্বাদ একেকটার চেয়ে একেকটা এত চমৎকার যে ভাষায় বর্ণনা দেয়া সম্ভব না।
নতুন কাপড় বা ঘুরাঘুরি কোনটার প্রতি তেমন আগ্রহ কখনোই ছিল না কিন্তু ঈদের নামাজটা মনে হত সবচেয়ে প্রাণ ভ্রোমরা আর ঈদুল ফিতরের দিনে সকাল বেলা আলো ফুটতে থাকা অবস্থায় একটু খাওয়া ছিল অন্যতম আনন্দের।কোরবানির ঈদে গরুর ডিসেক্টিং টা অনেক কষ্টের হলেও ওটা ছিল আরেক আনন্দের মুহূর্ত।
এক সময় ইত্যাদির জন্য বা ভালো সিনেমার জন্য টান ছিল।২০০৩/০৪ এর পর থেকে টিভির প্রতি আগ্রহ তেমন ছিল না বললেই ছিল(মানে বিনোদনের প্রতি)। কিন্তু টান কমতো না পরিবেশ দেখার প্রতি।
এতদিনে অনেক কিছুই ভুলে গেছি,অনেককেই ভুলে গেছি,মা বাবা ভাই বোন এখনো কাঁদে কি না সেটা জানা হয়নি।আমার ঘর আর আমার বাসস্থান আমাকে মনে করে কাঁদে কি না তাও জানি না।সেই আমার কল্পনার ইদ কি আছে?তা না জানলেও ঈদ যে ফেইসবুকে টেক্সটিং আর পোস্টিং হয়ে গেছে তা বেশ বুঝতে পারছি।
দোকানে এখন অরগানিক সব কিছু বিক্রি করে।নর্মাল এর চেয়ে অনেক দাম বেশী।কিছু লোক নেয় অরগানিক কিন্তু বেশীর ভাগ লোকই নর্মাল জিনিষপত্র নেয়,দাম কম বলে পরিমাণে বেশী বলে।অথচ ক্যামিক্যাল মিশানো এই নর্মাল যে এবনর্মাল তা ভুলে না গেলেও ভুলে থাকার চেষ্টা করি।এটাও অনেকটা ঈদের মত হয়ে গেছে।মাঠে ময়দানে ছুটে চলা আর সেই চিল্লাচিল্লির যে স্বাদ তা ন্যাচারাল আর কার্যকরী যা আজকে অরগানিক নামে পরিচিত সেই স্বাদ খুব কম পাই আমরা।নর্মাল টেক্সটিং আর পোস্টিং এ আমাদের সব ঢেলে দিয়ে দিন শেষে খুঁজি কি পেলাম আর কি পাই নি !
স্মৃতির ঈদে আগামী দিনে কি গল্প হবে সেটাই এক বড় বিস্ময় হয়ে যাবে।
এক বড় ভাই গল্প করছিল যে আশেপাশের ৪ গ্রামে ঈদের দিন বেড়াতেন।এ যে শুধু কাল্পনিক ধরনের গল্পই হয়ে যাচ্ছে তার উদাহরণ উনি গতকাল দিনের তিন চতুর্থাংশ আমার বাসাতেই কাটিয়ে দিয়েছেন।কিন্তু পেয়েছেন পানসে এক বিকট টেস্ট।
সবকিছুর মধ্যেই বাংলাদেশ খুঁজি,চিন্তা চেতনায়,ধ্যানে জ্ঞানে এমন দেশের কথা ভেবেই প্রতিদিন যেন গেয়ে উঠি " এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না তো তুমি -- "
কিন্তু সম্ভিত ফিরে পেলে ফেলে আসা দেশ আর বর্তমানের দেশের পার্থক্য যখন আকাশ আর পাতাল দেখি তখন মনে হয় আবার কি ফিরে যেতে পারবো হারানো সেই আমার দেশীয় ঈদে নাকি ইদ হয়ে হারিয়ে যাবে সকল ভালোবাসার প্রাকৃতিক অরগানিক পরিবেশ?
"দেশটা আমার রক্তে কেনা
দেশটা আমার মায়ের দেনা
দেশটা আমার দুঃখী বোনের হাসি
বাংলাদেশকে আমি ভালোবাসি"
প্রথম দেখা।
হাসানূর রহমান
পৃথিবীর সবগুলো সকালে সূর্য পূর্ব দিক থেকে উঠলেও সব গুলো সকাল এক রকম হয় না।একজন মানুষের জীবন চলে যায়।কাজ খাওয়া ঘুম।পরিবারের দায়িত্ব পালন।মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাওয়া না পাওয়ার হিসেব।একটা বয়সে এসে মোটামুটি সবাই একবার হলেও ভাবে,হে আল্লাহ আমার গাড়ী বর বাড়ীর দরকার নেই,কোনওমতে দুটো ডালভাত হলেই চলবে।এই দুটো ডালভাত যোগাতেই হিমশিম খেতে হয়।জগতের বাস্তবতায় কিছু চাওয়া পাওয়া গুলি সামনে এলেও অতীতের কিছু চাওয়া বাস্তবতার ভারে চাপা পড়ে।ওগুলো আর কোন মতেই মুখ তুলতে পারে না।আমরা এক সময় ভূলে যাই।যতদিন না পর্যন্ত সেই সব ভারি বাস্তবতা গুলো সরানোর দরকার হয়।
এক দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে চা খাচ্ছি,অফিসে যাওয়ার প্রিপারেশান নিচ্ছি মনে মনে।অনান্য দিনের মতই সকাল।আমার স্ত্রীরর নাম অনিতা।অনিতাও খুব ব্যাস্ত অনান্য সকালের মত।হটাৎ অনিতা আমার সামনে এসে মুখ কাল করে ঠাস করে কপালে চাপ দিলো।বুঝলাম হয়ত কিছু ভূলে গিয়েছে,আমি খুব একটা পাত্তা দিলাম না।এটা হরহামেশা হয়েই থাকে।একটি সিগরেট ধরিয়ে আমি চা পানে মন দিলাম।
অনিতা হন হন করে গিয়ে ঘর থেকে একটি বড়সড় খাম নিয়ে এলো।আমার সামনে টেবিলে রাখল।আমি খামটা হাতে নিলাম।একটি বিয়ের কার্ড।মুহুর্তে একটি ঝটকা বাতাস আমার জীবনে জড় বস্তুর মত পড়ে থাকা ভাড়ি বাস্তবতা এক নিমিশে সরিয়ে কিছু অনুজ্জল মিইয়ে যাওয়া স্মৃতি হটাৎ চোখের সামনে মেলে ধরল।বাস্তবতার ভাড়ে চাপা এই শ্বাস আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া বুক হটাৎই অনাগত মুহুর্তের আশংকায় শংকিত হয়ে অস্বাভাবিক একটা অনুভূতির জন্ম দিল।
আমি আর খামটা খুলে দেখলাম না।কন্ঠ যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে অনিতা কে জিঙ্গেস করলাম' কবে অনুষ্ঠান?'
'নেক্সট মান্থের চার তারিখ,বাট আমাদের চার দিন যেতে হবে।আমি কিন্তু অনেক কিছু ভেবে রেখেছি,এবার কিন্তু অনেক মজা করব।তুমি কিন্তু না করতে পারবে না....'
'আমি এসব ব্যাপারে কখনও তোমাকে নেগেটিভ কিছু বলেছি??'
অনিতা এসে আমাকে পেছন থেকে জরিয়ে ধরল।কপলে কপল ছোয়ালো।
"আমি জীবনে কি ভাল কাজ করেছিলাম জানি না,যার প্রতিদান আল্লাহ আমাকে তোমার মত একজন জীবনসঙ্গী দিয়ে দিয়েছেন,আমি অনেক হ্যাপি"
"তো এই ভাল জীবনসঙ্গী কে কি অফিস যাওয়ার আগে আর এক চা কি খাওয়ানো যাবে?" আমি সুযোগের সৎব্যাবহার করলাম।চা বানাতে বললে অনিতা রেগে যায়।যখন মুড ভাল থাকে তখন পরপর কয়েক কাপ চা খেয়ে নিই।
অনিতা তুড়ি বাজিয়ে কিচেন এ গেল।আমি দীর্ঘশ্বাস ফেল্লাম।চা মনে হয় না গলা দিয়ে নামবে।গলার ভেতর কিছু একটা দলা পাকিয়ে আছে।আমি কার্ডের দিকে তাকিয়ে আছি।
অফিস যাওয়ার আগে সময় নিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখলাম।এই আটত্রিশ বছর বয়সে অনেক কিছুই আমার ভেতর থেকে চলে গেছে।অনেক কিছুই নতুন করে যোগ হয়েছে।
আজ অফিসে একটু দেড়িতেই পৌছালাম।মাথায় হাজার খানেক চিন্তা এসে ঘুরপাক খাচ্ছে।আমার ছোট অফিস।বসের ইটভাটা, রেস্টুরেন্ট আর কিছু কোম্পানির এজেন্সি আছে।আমি এই অফিসের ম্যানেজার।তিন জন ম্যানপাওয়ার।আমি সহ চার জন।আমার বস বাবার বন্ধু ছিলেন।অনার্স কম্পলিট করার পর কোথাও কিছু না পেয়ে শেষে বাবার রিকোয়েস্টে আমাকে এখানে চাকুরি দিয়েছিলেন।আমি এখানে বেশ ভাল আছি।স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখের সংসার।বস আমাকে বিশ্বাস করে সব কিছু আমার উপরে দিয়ে রেখেছেন।আমিও চেষ্টা করে যাচ্ছি।আমি পুরো অফিসে চোখ বোলালাম।খুবই সাধারন অফিস।আমার কোন পারসোনাল কামরা নেই।ছোট্ট একটা টেবিল আমার জন্য ছোট্ট একটি চেয়ার।গেস্টদের জন্য আমার টেবিলের সামনে দুটি চেয়ার।একজন পিয়ন আছে মালিকের আত্বিয়।তাকে অর্ডার করার চেয়ে নিজে কাজ করা অনেক ভাল।এখানে আমায় কেউ স্যার ডাকে না।বেল দিলে চা কফি আসে না।মাস শেষে মোটা মাইনে পাই না।এসির বাতাস নেই ক্রেতা দূরস্ত পোশাক নেই।একজন ছেড়ে যাওয়া প্রেমিকার প্রতিশোধের জন্য এরচে ভাল নিদর্শন আর হতেই পারে না।ব্যার্থতার সব উপকরনই আমার, আমার কাজের মধ্যে বিদ্যমান।যেন অদৃষ্টের হাসি।
আমি অফিসে বসে এসিট্যান্ট ম্যানেজার রেজা কে ডাকলাম।
"শফিক ভাই খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে,ব্যাপার কি?"
"রেজা,নেক্সট মান্থের ফাস্ট উইকে কি কোন ট্যাুর আছে ঢাকা চিটাগাং?"
"আগামী দুই মাস কোন ট্যুর নেই,কেন শফিক ভাই ভাবির সাথে ঝগড়া করেছেন নাকি? "গলা নিচু করে কথাটি বলে,গলা চড়িয়ে হো হো করে হাসল রেজা।
"না না একটা বিয়ের অনুষ্ঠান আছে তো তাই আস্ক করলাম।"
"এইটা কোন কোথা বল্লেন শফিক ভাই,আমি আছি,রিমন আছে।ট্যুর থাকলে আমরা যাব।আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন"
আমি দীর্ঘশ্বাস ছারলাম।অফিসের কাজে মন বসল না।আমি তারাতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম।
সন্ধ্যা সাতটায় বাসায় ঢুকে আমার মনটা ভাল হয়ে গেল।আমার একমাত্র সন্তান দৌড়ে আমার কাছে এসেই অভিযোগ করতে শুরু করল,আমি এত দেরিতে কেন এলাম।আমি মাহিম কে কোলে তুলে নিলাম।অনেক বড় হয়েছে।আর দু মাস পর সাতে পরবে।মাহিমের মাঝে আমি নিজেকে দেখতে পাই।সেই গায়ের রঙ,সেই নাক,সেই চোখ মাথা ভর্তি কালো চুল।আমরা মতই লম্বা হবে ছেলেটি।চেহারায় মায়ের কোমলতা আছে।আমার বুকের ঘনীভূত কষ্ট মাহীম কিছুটা কমিয়ে দেয়।আমার বড় বাড়ী নেই,বড় চাকরি নেই,গাড়ী নেই কিন্তু আমার অনীতা আছে মাহীম আছে।এক সময় আমি সন্ধ্যাকে ছারা কিছু কল্পনা করতে পারতাম না।এখন মনে হয় সেই সব কল্পনা ছিল ছাই পাশ।মাহীম অনীতার কাছে সেই সব ধুলোও হবে না।মনে মনে হাসলাম।যেন আমি হেরেও জিতেছি।
আমার সেঝ খালার ছেলের বিয়ে।একই শহরে বাড়ি।আমার সেঝ খালার ছেলে আর সন্ধ্যা চাচাত ভাই বোন।আমার আর সন্ধ্যার সম্পর্কটা সেখান থেকেই শুরু।লম্বা সম্পর্কের পরিনতিটা সুখকর হয় নি।সন্ধ্যা অবস্যই তার কাজিনের বিয়েতে আসবে।আমাকেও আমার বউ বাচ্চা নিয়ে হাসিমুখে যেতে হবে।অনিতা কিছুই জানে না।অনেকেই আমাকে আর সন্ধ্যাকে লুকিয়ে দেখবে আমাদের রিএকশ্যন দেখার জন্য।অনিশ্চয়তার কালো আধারে ডুবে আমি সেই অনাগত মুহুর্তের অপেক্ষায় থাকি কিছুটা শঙ্কা নিয়ে।আমাদের নিজ,সমাজ,পৃথিবীর সাথে অভীনয়ের এক নতুন মাত্রা যোগ হবে সেদিন সন্দেহ নেই।প্রথম দেখা হবে।সম্পর্ক ভাঙার প্রায় বারো বছর পর প্রথম দেখা.........
আমি যখন আমার ছেলের দিকে তাকাই, ওর মাঝে আমারই ছায়া খুঁজি। যেমনটা আমার বাবা খুঁজতেন আমার মাঝে তাঁর ছায়া, তাঁর বাবা খুঁজতেন তাঁর মাঝে তাঁর.....এবং এধারা সেই সৃষ্টির শুরু থেকেই বয়ে আসছে হয়তোবা।
প্রতিটা বাবাই বোধয় চান, তাঁর সন্তান তাঁর রক্তের পাশাপাশি তাঁকেও ধারণ করুক। তাঁর স্বভাব-চরিত্র, তাঁর ঐতিহ্য লালিত হোক তাঁর সন্তানদের মাঝে। বাবারা একদিন মাটির সাথে মিশে যান, সময় একদিন তাঁদের স্মৃতি ধুয়ে নিয়ে যায় - তবু তাঁরা বেঁচে থাকতে চান তাঁদের সন্তানদের হাত ধরে, বংশ পরম্পরায়; জন্ম থেকে জন্মান্তরে।
আমার ঈদের গল্প আমার জেনারেশনের আট দশটা মানুষের জীবনের ঈদের গল্প থেকে ভিন্ন নয়। ঈদের আগে কেনাকাটা করা, ঈদের দিন নতুন জামা/জুতা পড়া হবে, এই খুশিতে ঘুম থেকে উঠা, সকালে বাবার সাথে গিয়ে ঈদের নামাজ পড়া, আত্মীয় মুরুব্বিদের সালাম করা, কিছু কিছু আত্মীয়ের কাছ থেকে সালামী পাওয়া এবং রাতে হুমায়ূন আহমেদের নাটক এবং ইত্যাদি দেখা। কারোর সাথেই ব্যতিক্রম নেই।
বন্ধু বান্ধবদের অনেকেই দেশের বাড়ি গিয়ে ঈদ করতো। আমাদের সেটা করতে হতো না। দাদা দাদি নানা নানীদের যৌথ পরিবারেই আমাদের বেড়ে উঠা। ঈদের সময়ে "এ জার্নি বাই বোট/ট্রেন/বাস" হতোনা বলে তখন মন খারাপ হতো, গ্রামে গিয়ে "এডভেঞ্চারাস ঈদ" হতোনা বলেও অতৃপ্ত থাকতো মন - তবুও এখন ভাবি আমরা কতটা সৌভাগ্যবান ছিলাম! তখনকার যৌথ পরিবারে প্রতিদিনের আনন্দবেদনার কাব্যের অংশ হয়ে বেড়ে উঠার আনন্দ এখনকার একক পরিবারের শিশুরা উপলব্ধিই করতে পারবে না। সেসব দিন তুলনাহীনা।
শৈশবের ঈদ শীতের দিনে হতো। তাই সকালে ঘুম থেকে উঠাটা ছিল অত্যন্ত কঠিন। তার উপর গোসল করাটাতো ছিল রীতিমতন অভিশাপ।
সেই ভোর থেকে চুলায় গরম পানি ফুটতে থাকতো, বালতিতে ঢালার পরে একজন একজন করে ভাইবোন গোসলে যেতাম। বাবা বলতেন, "তোমরা কতটা সৌভাগ্যবান তোমরা জানোনা, কল খুললেই পানি চলে আসে। আমাদের সময়ে কুয়াশা ঢাকা শীতের দিনে পুকুরে গিয়ে গোসল করতে হতো।"
তারপর তিনি বলতেন, "আমাদের বলা হতো, ঈদের দিন যে যত আগে গোসল করবে, সে তত আগে বেহেস্তে যাবে। আমরা বেহেস্তে যাবার লোভে দৌড়ে গিয়ে পুকুরে ঝাঁপ দিতাম। আর কাঁপতে কাঁপতে উঠে আসতাম।"
আল্লাহর রহমত, আমাদের বেহেস্তে যাবার সেই দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হয়নি। আমার ছেলেকে অবশ্য চুলায় পানি ফোটার জন্যও অপেক্ষা করতে হয় না। ওকে আমাদের চেয়েও ভাগ্যবান বলাই যায়। তাঁর সন্তান কী বিছানায় শুয়ে শুয়েই গোসল সেরে ফেলতে পারবে? হয়তো ওদের জন্য আবিষ্কার হবে এয়ার বাথ টেকনোলজির। বাতাসের মাধ্যমেই শরীরের সব ময়লা ধুয়ে সাফ হয়ে যাবে।
এবং চারিদিকে কবি নজরুলের সেই অমর সংগীত, "রমযানের ঐ রোযার শেষে এলো খুশির ঈদ...."
আমার এখনও এই গানটি কানে না আসলে মনে হয়না ঈদ এসেছে। গানটির কিছু চরণতো জীবন বদলে ফেলার মতন শক্তিশালী।
"যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা নিত্য উপবাসী।
সেই গরীব ইয়াতিম মিস্কিনে দে যা কিছু মুফিদ।।"
আমরা এক মাস রোজা রেখেই কাহিল হয়ে যাই, যাদের জীবনভর রোজা রাখতে হয় - তাঁদের কষ্ট আমরা উপলব্ধি করি?
বাবা যখনই কোন ফকির মিসকীনকে দান করতেন, আমাদের মাধ্যমেই করতেন। আমাদের হাতে টাকা দিয়ে বলতেন, "ওকে টাকাটা দিয়ে তোমাকে এমন পরিবারে জন্ম দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো। আজ ওর জায়গায় তুমিও থাকতে পড়তে।"
ঈদের জন্য আমাদের সাধারণত এক সেট জামাই কেনা হতো। এক সেট পাঞ্জাবি এবং আরেক সেট গেঞ্জি/শার্ট এমন ঘটনা খুব বেশি ঘটতো না। প্রতি ঈদেই যে নতুন নতুন পাঞ্জাবি পড়েছি - তা নয়, আগের বারের পাঞ্জাবি ধোপাকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে, কড়া মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করিয়ে ঈদের জামাতে গিয়েছি এমন বহুবার ঘটেছে। এই অভ্যাস এখনও রয়ে গেছে। নিজের জন্য নতুন জামা পেলে আমি খুশি, না পেলে সত্যিই কিচ্ছু যায় আসেনা। আমরা বাবা মায়ের উপর চাপ দেইনি কখনও। তাঁদের আয় মোটামুটি ভাল হলেও ছিলতো সীমিতই। আমাদের ছাড়াও আরও কারোর কারোর জন্য বাজেট তোলা থাকতো। পাড়ায় পোলিও আক্রান্ত এক ছেলে ছিল, ফয়সাল নাম। দুই লাঠিতে ভর দিয়ে পাড়ায় চক্কর দিত। হাসিটা এত সুন্দর ছিল যে বুকে এসে বিঁধে। ঈদের দিনে তাঁর জন্য কাপড় কেনা হতো। বাবা নিজের হাতে তাঁকে দিতেন। এবং তিনি তাঁর তিন সন্তানকেই শারীরিকভাবে নিখুঁত বানাবার জন্য উপরওয়ালাকে ধন্যবাদ দিতেন। বিকলাঙ্গ সন্তানের পিতামাতা হবার মনোকষ্টের তুলনায় নরকবাস কিছুই না।
এছাড়া আমাদের কিছু বাজেট তোলা থাকতো এমন কিছু মানুষের জন্য যাদের অবস্থা কোন ভিখিরির চেয়ে কম খারাপ নয়, এবং তাঁরা কখনই হাত তুলে ভিক্ষা চাইবে না। মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনরা ছিলেন তেমনই সম্প্রদায়ের লোক। কেউ বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা, তাঁদের মাসিক বেতন অবিশ্বাস্য রকমের কম হয়ে থাকে। এত কম টাকায় তাঁরা কিভাবে সারভাইভ করেন, তাঁরাই জানেন। তাঁদের জন্য পাঞ্জাবি, লুঙ্গি এবং তাঁদের স্ত্রীদের জন্য শাড়ির টাকা আলাদা তোলা থাকতো। ইমাম সাহেব তাঁর কাপড় নেবার সময়ে স্পষ্টই জানিয়ে দিতেন, তিনি যাকাতের টাকা নেন না। বাবা "উপহার" হিসেবে দিলে তবেই নিতেন।
এইবার ঈদে আমরা স্বপরিবারে নামাজে গেলাম। দেশে কেন মহিলাদের ঈদের জামাতে নেবার প্রচলন নেই আমি ভেবে পাইনা। হাদিসেতো যতদূর জানি রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন মেয়েদের ঈদের নামাজে যেতে, এবং নামাজ পড়তে না পারলেও দোয়ায় অংশ নিতে।
যাই হোক, মসজিদের মহিলা কক্ষে দেখা গেল এক মা তাঁর শিশুকে এক ঝুড়ি চকলেট ভর্তি গুডি ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বললেন সব শিশুদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে। শিশুটি মহানন্দে সেই কাজটি করছে। আমার ছেলের ভাগ্যেও এক ব্যাগ চকলেট জুটলো উপহার।
ব্যাপারটি আমার এত ভাল লেগেছে যে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামী বছর ইন শা আল্লাহ এই কাজটা আমিও করবো। এক বস্তা চকলেট কিনে ছোট ছোট ব্যাগ বানিয়ে নিজের বাচ্চাকে দিয়ে অন্য বাচ্চাদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে শেখাবো। রিফিউজি ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে গৃহহীন নির্দোষ শিশুদের ঈদ উপহার দেয়ার মাধ্যমে সে কতটা সৌভাগ্যবান সেটা উপলব্ধি করাবো।
তারচেয়ে বড় কথা, আমি শেখাতে চাই দোস্ত-দুশমনি ভুলে হাত মিলিয়ে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন কেবল ঈদের দিনেই নয় - বছরের প্রতিটা দিনেই করতে হয়। আমি মুসলিম, ও কাফির; আমি সুন্নি, ও শিয়া; আমি হানাফী, ও সালাফি; আমি বাঙালি, ও বিদেশি জাতীয় নিম্নশ্রেণীর মানসিকতা ত্যাগ করে ও যেন বুঝতে শেখে প্রতিটা সৃষ্টিই আল্লাহর আপনজন। যে তাঁর সৃষ্টির সেবা করে, তাঁর প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকেন। সে যেন ছোট ছোট বিষয়ে নিজেদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি না করে। সে যেন একটা দুইটা অমিল দেখে মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়ার পরিবর্তে হাজারো মিল খুঁজে বের করে সবাইকে কাছে টেনে নিতে শেখে। সে যেন সেই মানুষ হয়ে দেখায় যার সম্মানে আল্লাহ বলেছিলেন জ্বিন ও ফেরেশতারাও যেন সিজদাহ দেয়।
আমি না শেখালে ও শিখবে কার কাছে?
যদি ছেলেকে "মানুষ" বানিয়ে যেতে পারি, তাহলেই বুঝব মানব জন্ম স্বার্থক ছিল। আমি তাঁর কর্মেই অমরত্ব পাবো।
সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।